তিতাস বিধৌত রতœগর্ভা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ছোট্ট একটি উপজেলার নাম সরাইল। সরাইলের গ্রে-হাউন্ড কুকুর এক ধরণের উন্নত জাতের কুকুর। এই কুকুর চেহারা- আকৃতি-আচার আচরণে সব দিক দিয়েই অন্যান্য কুকুরের চেয় একবারেই আলাদা। এইসব কুকুরের মুখ অনেকটাই শেয়ালের মত। গ্রে-হাউন্ড কুকুরের কান ও লেজ লম্বা। সরাইলের কুকুরের গায়ে বাঘের মত ডোরাকাটা দাগ আছে। এর মধ্যে সব কুকুর সরাইলের খাঁটি নয়, শঙ্কর জাতের কুকুর ও রয়েছে সরাইলে। এই সব কুকুর অন্যান্য কুকুরের মত এতটা আহøাদী নয়। এদেরকে জড়িয়ে ধরার মত আদর এইসব কুকুর পছন্দ করে না।এইসব কুকুর খুব হি¯্র, নজর তীক্ষ ও দ্র্রুত দৌড়াতে পারে। এরা খুব শিকারী জাতের কুকুর। শিকারের টার্গেট করলে কোন দিনই মিস হওয়ার কোন নজির নাই বললেই চলে। আর এইসব কুকুরের লেজ থাকে নীচের দিকে, এরা চিকন ও লম্বাটে হয়। এদের পায়ের থাবাগুলো বাঘের মত হয়। মুখটা লম্বাট ধরণের হয় এমনকি খুব বেশী দৌড়াতে পারে। প্রতি ঘন্টায় একটি কুকুর ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়াতে পারে। সরাইলের কুকুর এদেশ প্রথম এনেছিল ব্রিটিশরা। তারা এইসব কুকুর গুলো লালন পালন করিত। তখন এইগুলো ছিল ব্রিটিশদের বাড়ীর শোভা এবং অনেকটাই প্রহরীর মত। এগুলো দেখতে বিদেশী কুকুরের মতো। অন একটি ঐতিহাসিক সুত্র থেকে জানা যায়,সরাইলের জমিদার দেওয়ান মোস্তফা আলীই প্রথম এ জাতের কুকুর সরাইল আনন। এদর আদিবাসী ইউরোপ। দুইশ বছর আগে তদানীন্তর সরাইল পরগনার জমিদার দেওয়ান মন্ন ুআলী একজন আফগান সওদাগর মতান্তরে ইংরেজ সাহবর নিকট থেকে হাতির বিনিময়ে বিশেষ জাতের এক মাদী কুকুর সংগ্রহ করেন। সেই মাদী কুকুর থেকেই পরবর্তীত অনেক ধাপ এগিয়ে এসেছে এ বিখ্যাত জাতের কুকুর। আশির দশক পর্যন্ত সরাইল সমৃদ্ধ ছিল কুকুরে। বিখ্যাত এই কুকুর পরিণত হয়েছিল এলাকার ঐতিহ। কুকুরের কারণে সরাইলের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে-বিদেশে। ঐ সময় সরাইল নিয়মিত এইসব গ্রে-হাউন্ড কুকুরের প্রদর্শনী হতা। যার কুকুর সবদিক দিয়ে ভাল তাক দেওয়া হত সেরা পুরস্কার। তখন ছিল কুকুর সংরক্ষণাগার কেন্দ্র। ১৯৮৩ সাল সরকারীভাবে হাউন্ড কুকুর রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখনই ৩২ হাজার টাকা ব্যয় করে সরাইল ৪ কক্ষবিশিষ্ট কুকুর সংরক্ষণাগার কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দু,তিন বছরের মধ্যেই এটি বন্ধ হয় যায়। সরাইলের প্রতিটি বাড়িতে ছিল এই কুকুরর আনাগানা। নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই লোকজন এগুলো পুষতেন। আর যেই বাড়িতে এইসব কুকুর থাকতো, ঐ বাড়িতে রাত্রে তো বটেই, দিনের বেলায়ও অপরিচিত লোক প্রবেশ করতে পারতো না। প্রতিটি কুকুর বিশ্বস্ততার সাথে মালিকের বাড়ি পাহারা দিত। কোন একটি কুকুর অসুস্থ হয়ে পড়লে ঘুম হারাম হয়ে যেত মালিকের। খুব দ্র্রুত কুকুরটিকে নিয়ে যেত হাসপাতালে। কিন্তু অযতেœ অবহেলার কারণে আজ কুকুর গুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। কুকুরের মালিকেরাও আগের মত এসব কুকুরের দেখভাল করেন না। সরাইলের কুকুর নিয়ে কিছু কিংবদন্তি চালু আছে। 2সরাইলের কুকুরের জ›ম নিয়ে আছে মিথ। মুখটা অনেকটা শেয়ালের মত হওয়ায় একটি মিথ শেয়ালের সাথে সম্পৃক্ত। বলা হয় ,জানা যায় একবার সরাইলের দেওয়ান জমিদার হাতি নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথে তিনি এই কুকুরটি দেখত পান। কুকুরটি কেনার চেষ্টা করেন কিন্তু মালিক রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত হাতির বিনিময়ে এই কুকুর কেনা হয়। পর কুকুরের সঙ্গে শেয়ালের সংমিশ্রন যে প্রজাতির কুকুরের জ›ম হত সেটাই ছিল সরাইলের গ্রে-হাউন্ড কুকুর। অপর মিথটি সরাইলের কুকুরের গায়ের রঙ্গেও কারণে। বলা হয় জমিদার দেওয়ানের এই কুকুর এক সময় হারিয়ে যায় বনে। বেশ কিছুদিন পরে কুকুরটি ফিরে আসে গর্ভবতী হয়ে। বাচ্চা প্রসব করার পর দেখা গেল এর সাথে বাঘের বেশ মিল রয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল বাঘের সঙ্গে মিলনের ফলে এই প্রজাতির উৎপন্ন। মিথা যাই বলুক,এর বিশ্বাসযাগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থকে যায়। এ ধরণের মিলন প্রাকৃতিক নয়। এক প্রজাতির কুকুরের সাথে আরেক কুকুরের মিলন হতে পারে। সেক্ষেত্র তাদের সংকর বাবা- মা,র বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জ›মাতে পারে। কিন্তু এক প্রাণী অন্য প্রাণীর সঙ্গে মিলন প্রাকৃতিক নয়। অবশ্য বর্তমান বিজ্ঞান এ ধরনের শঙ্কর তৈরী করার চেষ্টা করছে।
এই কুকুর পালন করেন বিত্তশালীরা। প্রতিদিন দুই-আড়াই কেজি খাদ্য দিতে হয় একটি পুর্ণবয়স্ক কুকুরকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়েক জেনারেল ওসমানী দুইটা সরাইলের কুকুর ছিল। এই সরাইলের কুকুর নিয়ে বেশ কিছু কাহিনীও রয়েছে। শোনা যায়, গ্রেট পাকিস্তানী সনদের উপস্থিতি জানিয়ে দিয়েছিল এই কুকুর গুলো। ফলে জেনারেল ওসমানী বেঁচে গিয়েছিলেন। আরেকটি কাহিনী থেকে জানা যায়,পাশের আদরের কুকুরটি নাকি ছিড়ে ফেলছিলেন এই সরাইলের কুকুর। প্রচুর প্রভুভক্ত এই কুকুর হিং¯্রতায় কম নয়। শিকার এদের রক্ত মিশে আছে। সরাইলের কুকুরের মুল ক্ষমতা কিন্তু তার ঘ্রাণশক্তিতে নয় বরং তার দৃষ্টিশক্তিতে। খরগোশ , শেয়াল, বাঘডাশ ইতাদি শিকার খুব দক্ষ। ডঃ শাহজাহান ঠাকুর নামে একজন গবেষক ২০০১ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সরাইলের কুকুর প্রজননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিভিন্ন গবেষণায় তিনি প্রমাণ করেছিলেন সরাইলের কুকুর আমাদের ঐতিহ্যের গুরুত্বপুর্ণ অংশ। বিভিন্ন কারণে তার এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেনি। সম্প্রতি এলিটফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ডগস্কোয়াডে যুক্ত হয়েছে সরাইলের বিখ্যাত ৬টি কুকুর। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এদেরকে তৈরী করা হয়। সরাইলের কুকুর বর্তমান অস্তিত্বের হুমকিতে আছে। এলাকার কয়েকটি বাড়িতে দেখা মেলে এইসব কুকুরের। সারা দেশে খাঁটি সরাইলের কুকুর প্রায় হাতেগোনা। এক সময় সরাইলের কুকুর পালন করতে স্থানীয় বেশ কিছু পরিবার। কিন্তু 3পারিবারিক এই ব্যবসা থেকে সরে এসেছেন অনেকেই। বর্তমান রয়ে গেছেন সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের অজিত লাল দাস, তপন বিশ্বাসেরা। তাঁরাই শুধু এই বিরল প্রজাতির কুকুর লালন-পালন করেছেন। কিন্তু এ পরিবারটি কুকুর প্রতিপালন করতে গিয়ে দারিদ্রতায় নিমজ্জিত। তপন বিশ্বাস আমাদেরকে জানান, কুকুর গুলোর ভালো দাম পেতে মাংসসহ উন্নতমানের খাবার দিতে হয়। তবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় কুকুরগুলোকে ঠিকমত খাবার দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তিনি জানান,সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে উপমহাদেশখ্যাত সরাইলের এই বিরল প্রজাতির কুকুরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব। ধরা যায় ৩ থেকে ৫ মাসের একটি বাচ্চা কুকুর ২০-২৫ হাজার টাকা আর বড় কুকুরের দাম ৬০-৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয় বলে জানান তপন বিশ্বাস। সরাইলের ইতিহাস-ঐতিহের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিরল প্রজাতির গ্রে-হাউন্ড কুকুর প্রতিপালনের সঙ্গে জড়িত পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের নিকট দাবি জানিয়েছেন সরাইলের সাধারণ মানুষ। ব্রাক্ষণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা বলেন, গ্রে-হাউন্ড কুকুর রক্ষায় বিগত এরশাদ সরকারের আমলে একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকারের সময়ও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, সুযোগ পেলে সরাইলের ঐতিহ্যবাহী এই কুকুর রক্ষার বিষয়টি তিনি জাতীয় সংসদ অধিবেশন তুলে ধরবেন। বর্তমান এ অবস্থায় বিরল প্রজাতির এই প্রাণীটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এমনটাই আশা করছেন সরাইলের সাধারণ মানুষ। এখন প্রয়োজনীয় সরকারী ও বাণিজ্যিক উদ্যোগ সরাইলের কুকুর প্রজনন এবং রফতানী করা। বয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত হয়তো সরাইলের কুকুরের এক সময় বাংলাদেশকে চিনতে সাহায্য করবে।
4সরাইলের কুকুরের বিশেষত্ব হল এরা সাধারণ কুকুরের চেয় অধিক ক্ষিপ্র,কষ্ট সহিঞ্চু শারিরীক গঠনটা একটু হালকা-পাতলা। ক্ষিপ্রতার কারণ এদেরকে সাধারণ মানুষ, চোর কিংবা ডাকাতরা একটু বেশিই ভয় পায়। শিয়াল, বনবিড়াল,বাঘডাস শিকারে এরা বেজায় পারদর্শী। তাছাড়া চোর-ডাকাতেরা একটু বেশীই ভয় পায় এই কুকুরকে। জানা যায়, এক সময় এই কুকুর দিয়ে শিয়াল,বাঘডাস,খাটাস শিকার করা হত। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ এই কুকুরের অস্তিত্ব পায় বিলিন হবার পথে। তপন বিশ্বাস আক্ষেপ করে আমাদেরকে আরও জানান, তিনি নিজ যে ঘরে থাকেন সই ঘরে বর্তমানে তিনি কুকুর রাখছেন, তব এখানেও নাকি কুকুর রাখা নিরাপদ নয়। এর কারণে প্রায়ই এই দামী কুকুর নিয়ে যেত চোর-ডাকাত হানা দেয়। তাছাড়া দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকমত খাবার দেওয়া ও তার জন্য কষ্ট হয় পড়ে। তিনি বিখ্যাত এই কুকুরটি ধরে রাখতে সরকারী সাহায কামনা করেন।
সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরান হোসেন আমাদের সংবাদ প্রতিদিনকে জানান, সরাইলের ঐতিহের মধে গ্রে-হাউন্ড কুকুর অন্যতম। দেশ-বিদেশের অনেকেই সরাইলকে চেনে এ কুুকুর দিয়ে। সরাইল সরকারী ভাবে এ প্রজনন কেন্দ্র করার পরিকল্পনা নয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার আয়তন
Climb the mountains
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরাইলের ঐতিহ্যবাহী গ্রে-হাউন্ড কুকুর
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment